Header Ads

Header ADS

কাজী নজরুল ইসলাম জীবনী পর্ব _৩

 


- কবি নজরুলের সাথে কুমিল্লার নার্গিসের প্রেম ইতিহাস

(প্রথম পর্ব) 

নজরুলের প্রথম প্রেম সৈয়দা খানম (নজরুল তাকে নাম দেন নার্গিস, ফার্সি ভাষায় যার অর্থ গুল্ম)। তিনি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের মেয়ে ছিলেন। তার মামা আলী আকবর খানের সাথে নজরুলে পরিচয় কলকাতায় ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে। আলী আকবর খান সম্রাট বাবরের জীবনী নিয়ে একটা নাটক লিখেছিলেন এবং টুকটাক পুস্তিকা লিখে নিজেই ফেরি করে বিক্রি করতেন। সেই সব পুস্তিকায় আলী আকবর খান রচিত কিছু কবিতাও থাকত। তার সেসব হাস্যকর কবিতা দেখে নজরুল নিজে “লিচু চোর” কবিতাটি আলী আকবর খানকে লিখে দেন। এতে খুশি হয়ে সে নজরুলকে তার গ্রামের বাড়ি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কুমিল্লাতে দাওয়াত দেন। এই আলী আকবরকে নজরুলের বন্ধুরা তেমন পছন্দ করতেন না এবং সর্বদাই তার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু সরল মনা নজরুল কখনই বন্ধুদের উপদেশ গ্রহণ করেন নি। ১৯২১ সালের মার্চে নজরুল আলী আকবর খানের সাথে বন্ধুদের কিছু না জানিয়েই কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ময়মনসিংহের ত্রিশাল ছাড়ার পর এটাই ছিল নজরুলের প্রথম পূর্ববঙ্গ যাত্রা। যাবার পথে তিনি “নিরুদ্দেশ যাত্রা” কবিতাটি লেখেন। 


ট্রেনে কুমিল্লা পৌছে নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর খান তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেন। বীরেন্দ্রকুমারের মা ছিলেন বিরজা সুন্দরী দেবী। একই বাড়িতে তার বিধবা জেঠিমা গিরিবালা দেবীও থাকতেন তার মেয়ে প্রমীলা সেনগুপ্তা (দোলন) ও আশালতা সেনগুপ্তাকে নিয়ে। চারপাঁচ দিন সেখানে কাটিয়ে কবি রওয়ানা দেন দৌলতপুরের খাঁ বাড়ির উদ্দেশ্যে। তবে সেই চারপাচ দিনেই সেনবাড়ির সবাই বিশেষ করে বিরজাদেবীর সাথে নজরুলের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। নজরুল তাকে “মা” সম্বোধন করতেন। 


দৌলতপুরে নজরুলের জন্য আলী আকবর খানের নির্দেশে উষ্ণ অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়। নির্মান করা হয় তোরন। বাড়ির জ্যেস্ট আত্মীয়-স্বজনদের সাথে নজরুল খুব দ্রুতই ঘনিষ্ট হয়ে উঠেন। তাদের কবিতা শুনিয়ে, অজস্র গান গেয়ে মুগ্ধ করে ফেলেন। দূরদুরান্ত থেকেও লোকেরা আসত কবিকে দেখতে, তার গান শুনতে। আলী আকবর খানের বোন আসমাতুন্নেসার বিয়ে হয়েছিল খাঁ বাড়ির পাশেই। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকায় আসমাতুন্নেসা তার ভাইয়ের বাড়িতে তেমন সমাদর পেতেন না। আসমাতুন্নেসার স্বামী মুন্শী আবদুল খালেক একটি মেয়ে রেখেই মৃত্যুবরণ করেন। সেই মেয়েটিই আমাদের আলোচ্য নার্গিস আসার খানম। 


নজরুলের গান, কবিতা, গল্প, বিদ্রোহ প্রভৃতি আমাদের কাছে বিখ্যাত। অথচ নার্গিসের সাথে কবির আলোচনার সূত্রপাত কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে। এক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দীঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশি সুরে মুগ্ধ হন নার্গিস। একদিন নজরুলকে এসে শুধান, “গত রাত্রে আপনি কি বাঁশি বাজিয়েছিলেন? আমি শুনেছি”। এই পরিচয়ের পরই নজরুল সেই যুবতি মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন। তার আচার আচরণে নার্গিসের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেতে থাকল। 


আলী আকবর খানও ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। মূলত নজরুলকে কুমিল্লা আনবার তার উদ্দেশ্য এই ছিল, নিজ পরিবারের কারো সাথে নজরুলের বিয়ে দেওয়া। তার পরামর্শে নার্গিসের খাঁ বাড়িতে আসা যাওয়া বাড়তে থাকে। নার্গিসে মাকে তিনি জানান, “এই ছেলে (নজরুল) একসময় জগৎ বিখ্যাত দার্শনিক কবি হবে। এই কাজীকে কোন রকমে আটকাতেই হবে। তাহলে ভবিষ্যতে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে”। পরবর্তীতে এই সব তথ্য নার্গিসের ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া যায়। খাঁ বাড়ির মুরব্বীরা নজরুলকে নার্গিসের বর হিসেবে তেমন পছন্দ করতেনা । বাঁধন হারা নজরুলকে তারা ছিন্নমূল বাউডুলে হিসেবেই দেখেছিলেন। কিন্তু গ্রাজুয়েট আলী আকবর খানের চাপে তারা প্রতিবাদ করতেন না। এক পর্যায়ে আলী আকবর খানের কাছে খোদ নজরুল বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করলেন, যার জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন। ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ আষাঢ় বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। 

এরপর শুরু হয় স্বপ্ন ভঙ্গের খেলা। আলী আকবর খান তার গ্রাম্য ভগিনীকে বিখ্যাত কবি নজরুলের জন্য গড়তে নেমে পড়লেন। অশিক্ষিত নার্গিসকে খুব কম সময়ে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব ছিল না কিন্তু তিনি শরৎচন্দ্র ও অন্যান্য সাহিত্যিকের উপন্যাসের নারী চরিত্র গুলো থেকে নার্গিসকে জ্ঞান দিতে থাকলেন। নজরুলের এইসব ভনিতা একেবারেই পছন্দ ছিল না, তিনি আলী আকবর খানকে তা জানালেও তিনি নজরুলকে পাত্তা দেন না। সেই সাথে খুব দ্রুত বিয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন, নিমন্ত্রন পত্রও অতিথিদের মাঝে বিলিয়ে ফেলেন। এসব ব্যাপার নজরুলকে পীড়া দেয়, আস্তে আস্তে তার মোহ ভাঙতে থাকে। 


এর ফাঁকে আলী আকবর খান আরো একটি কাজ করে যাচ্ছিলেন যা সবারই অগোচরে ছিল। তিনি নজরুলের জন্য কলকাতা থেকে আসা বন্ধুদের সব চিঠিই সরিয়ে ফেলতেন, সেই সাথে নজরুলের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে পাঠানো চিঠিও পোস্ট না করে নিজের কাছে রেখে দিতেন। তিনি ভালই জানতেন, নজরুলের বন্ধুরা কেউই কুমিল্লার আলী আকবর খানকে পছন্দ করেননা। সেই সাথে সন্দেহের চোখে দেখেন। এদিকে নজরুল বিয়েতে তার পক্ষের অতিথি হিসেবে বিরাজা সুন্দরী দেবী ও তার পরিবারকে মনোনিত করেন। বিয়ের আগের দিন সবাই দৌলতপুরে এসে উপস্থিত হন। কলকাতায় নজরুলের বন্ধুদের এমন সময় দাওয়াত দেওয়া হয় যেন কেউ আসতে না পারে। কবির অন্যতম ঘনিষ্ট বন্ধু কমরেড মোজাফফর আহমেদ নিমন্ত্রন পত্র পান বিয়ের পরে। 


এরপর এল সেই বহু প্রতিক্ষিত ৩ আষাঢ়। যতদূর জানা যায় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় এবং আকদ্ও সম্পন্ন হয়। কিন্তু কাবিনের শর্ত উল্লেখ করবার সময়ই ঝামেলা বাঁধে। আলী আকবর খান শর্ত জুড়ে দিতে চান, নজরুলকে ঘর জামাই থাকতে হবে। বাঁধন হারা নজরুল এই শর্ত প্রত্যাক্ষান করেন। আকদ্ হয়ে যাবার পর আনুষ্ঠানিক অন্যান্য কাজে যখন সবাই ব্যস্ত তখন নজরুল অন্তর্দ্বন্দে বিক্ষুব্ধ। তিনি ছুটে যান বিরজা সুন্দরী দেবীর কাছে। তাকে বলেন, “মা, আমি এখনই চলে যাচ্ছি”। বিরজা সুন্দরী দেবী বুজতে পারেন এই অবস্থায় নজরুলকে ফিরানো সম্ভব না। তিনি তার ছেলে বীরেন্দ্রকুমারকে নজরুলের সাথে দিয়ে দেন। সেই রাতে দৌলত পুর থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত কর্দমাক্ত (আষাঢ় মাস) রাস্তা পায়ে হেটে নজরুল ও বীরেন্দ্রকুমার কুমিল্লা পৌছেন। পরিশ্রমে ও মানসিক চাপে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। নজরুলের জীবনে নার্গিস পর্ব সেখানেই শেষ। 

১৯২১ সালের জুলাই মাসে নজরুল আলী আকবর খানকে চিঠিতে লেখেন, 

‘বাবা শশুর, 

আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মত ব্যবহার করে এসে যা কিছু কসুর করেছে, তা ক্ষমা করো সকলে, অবশ্য যদি আমার ক্ষমা চাওয়ার অধিকার থাকে। এইটুকু মনে রাখবেন, আম্র অন্তর-দেবতা নেহায়েৎ অসহ্য না হয়ে পড়লে আমি কখনো কাউকে ব্যাথা দিই না। যদিও ঘা খেয়ে খেয়ে আমার হৃদয়টাতে “ঘাটা বুজে’ গেছে, তবুও সেটার অন্তরতম প্রদেশটা এখনো শিরীষ ফুলের পরাগের মতই কোমল আছে। সেখানে খোঁচা লাগলে আর আমি থাকতে পারিনে। তা-ছাড়া আমিও আপনাদের পাঁচজনের মতই মানুষ, আমার গন্ডারের চামড়া নয়; কেবল সহ্য গুনটা একটু বেশি। আমার মান-অপমান সম্বন্ধে কান্ডজ্ঞান ছিল না বা ‘কেয়ার’ করিনি বলে আমি কখনো এত বড় অপমান সহ্য করিনি যাতে আম্র ‘ম্যানলিনেসে’ বা পৌরুষে গিয়ে বাজে- যাতে আমায় কেউ কাপুরুষ, হীন ভাবতে পারে। আমি সাধ করে পথের ভিখারী সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্র আত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি। আপন জনের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এই হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙ্গে দিয়েছে বাবা! আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। দোয়া করবেন আমার এ ভুল যেন দ’দিনেই ভেঙে যায়- এ অভিমান যেন চোখের জলে ভেসেযায়! 

বাকী উৎসবের জন্য যত শীগগীর পারি বন্দোবস্ত করবো। বাড়ির সকলকে দস্তুরমত সালাম দোয়া জানাবে। অন্যান্য যাদের কথা রাখতে পারি নি তাদের ক্ষমা করতে বলবেন। তাকেও ক্ষমা করতে বলবেন, যদি এই ক্ষমা চাওয়া ধৃষ্টতা না হয়। 

আরজ-ইতি 

চিরসত্য স্নেহ-সিক্ত 

নূরু। 


১৯২১ এর সেপ্টেম্বর মাসে আলী আকবর খান কুমিল্লা হতে আবার কলকাতা পৌছে নজরুলের সাথে দেখা করেন। নজরুলকে তিনি টাকার লোভ দেখান, এতে নজরুল আরো রেগে যান। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর নজরুলের সাথে নার্গিসের আর কোন যোগাযোগও হয় নি। ১৯৩৭ সালে নজরুলকে নার্গিস একটা চিঠি লেখেন। চিঠি প্রাপ্তির সময় সেখানে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। নজরুল তাকেই চিঠি পড়তে বলেন। চিঠি পড়া শেষে শৈলজানন্দ নজরুলকে উত্তর লিখতে বলেন। 

১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নজরুল নার্গিসকে আর একটি চিঠি লেখেন। এর প্রায় বছর খানেক আগেই শিয়ালদহতে নার্গিস ও নজরুলের উপস্থিতিতে উভয়ের আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। 


বিচ্ছেদের সাত-আট মাসের মাথায় আলী আকবর খানে বই ব্যবসার ম্যানেজার আজিজুল হাকিমের সাথে নার্গিসের বিয়ে হয়। আজিজুল হাকিমও বাংলা সাহিত্যে কবি হিসেবে সমাদৃত। এক সময় তিনিই নার্গিসের কাছ থেকে পাওয়া সেই ১৯২১ সালে আলী আকবর খানের সরিয়ে ফেলা নজরুলের বন্ধুদের ও বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠি গুলো প্রকাশ করেন। আলী আকবর খানের মূল চরিত্র জনসম্মুক্ষে প্রকাশিত হয়। 

(তথ্য সূত্র: নজরুলের জীবনেকাজী নজরুল ইসলামের জীবনী :- (পর্ব ৩)

💖নজরুল ও নার্গিস:-💖 (প্রথম পর্ব)

নজরুলের প্রথম প্রেম সৈয়দা খানম (নজরুল তাকে নাম দেন নার্গিস, ফার্সি ভাষায় যার অর্থ গুল্ম)। তিনি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের মেয়ে ছিলেন। তার মামা আলী আকবর খানের সাথে নজরুলে পরিচয় কলকাতায় ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে। আলী আকবর খান সম্রাট বাবরের জীবনী নিয়ে একটা নাটক লিখেছিলেন এবং টুকটাক পুস্তিকা লিখে নিজেই ফেরি করে বিক্রি করতেন। সেই সব পুস্তিকায় আলী আকবর খান রচিত কিছু কবিতাও থাকত। তার সেসব হাস্যকর কবিতা দেখে নজরুল নিজে “লিচু চোর” কবিতাটি আলী আকবর খানকে লিখে দেন। এতে খুশি হয়ে সে নজরুলকে তার গ্রামের বাড়ি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কুমিল্লাতে দাওয়াত দেন। এই আলী আকবরকে নজরুলের বন্ধুরা তেমন পছন্দ করতেন না এবং সর্বদাই তার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু সরল মনা নজরুল কখনই বন্ধুদের উপদেশ গ্রহণ করেন নি। ১৯২১ সালের মার্চে নজরুল আলী আকবর খানের সাথে বন্ধুদের কিছু না জানিয়েই কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ময়মনসিংহের ত্রিশাল ছাড়ার পর এটাই ছিল নজরুলের প্রথম পূর্ববঙ্গ যাত্রা। যাবার পথে তিনি “নিরুদ্দেশ যাত্রা” কবিতাটি লেখেন। 


ট্রেনে কুমিল্লা পৌছে নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর খান তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেন। বীরেন্দ্রকুমারের মা ছিলেন বিরজা সুন্দরী দেবী। একই বাড়িতে তার বিধবা জেঠিমা গিরিবালা দেবীও থাকতেন তার মেয়ে প্রমীলা সেনগুপ্তা (দোলন) ও আশালতা সেনগুপ্তাকে নিয়ে। চারপাঁচ দিন সেখানে কাটিয়ে কবি রওয়ানা দেন দৌলতপুরের খাঁ বাড়ির উদ্দেশ্যে। তবে সেই চারপাচ দিনেই সেনবাড়ির সবাই বিশেষ করে বিরজাদেবীর সাথে নজরুলের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। নজরুল তাকে “মা” সম্বোধন করতেন। 


দৌলতপুরে নজরুলের জন্য আলী আকবর খানের নির্দেশে উষ্ণ অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়। নির্মান করা হয় তোরন। বাড়ির জ্যেস্ট আত্মীয়-স্বজনদের সাথে নজরুল খুব দ্রুতই ঘনিষ্ট হয়ে উঠেন। তাদের কবিতা শুনিয়ে, অজস্র গান গেয়ে মুগ্ধ করে ফেলেন। দূরদুরান্ত থেকেও লোকেরা আসত কবিকে দেখতে, তার গান শুনতে। আলী আকবর খানের বোন আসমাতুন্নেসার বিয়ে হয়েছিল খাঁ বাড়ির পাশেই। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকায় আসমাতুন্নেসা তার ভাইয়ের বাড়িতে তেমন সমাদর পেতেন না। আসমাতুন্নেসার স্বামী মুন্শী আবদুল খালেক একটি মেয়ে রেখেই মৃত্যুবরণ করেন। সেই মেয়েটিই আমাদের আলোচ্য নার্গিস আসার খানম। 


নজরুলের গান, কবিতা, গল্প, বিদ্রোহ প্রভৃতি আমাদের কাছে বিখ্যাত। অথচ নার্গিসের সাথে কবির আলোচনার সূত্রপাত কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে। এক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দীঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশি সুরে মুগ্ধ হন নার্গিস। একদিন নজরুলকে এসে শুধান, “গত রাত্রে আপনি কি বাঁশি বাজিয়েছিলেন? আমি শুনেছি”। এই পরিচয়ের পরই নজরুল সেই যুবতি মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন। তার আচার আচরণে নার্গিসের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেতে থাকল। 


আলী আকবর খানও ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। মূলত নজরুলকে কুমিল্লা আনবার তার উদ্দেশ্য এই ছিল, নিজ পরিবারের কারো সাথে নজরুলের বিয়ে দেওয়া। তার পরামর্শে নার্গিসের খাঁ বাড়িতে আসা যাওয়া বাড়তে থাকে। নার্গিসে মাকে তিনি জানান, “এই ছেলে (নজরুল) একসময় জগৎ বিখ্যাত দার্শনিক কবি হবে। এই কাজীকে কোন রকমে আটকাতেই হবে। তাহলে ভবিষ্যতে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে”। পরবর্তীতে এই সব তথ্য নার্গিসের ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া যায়। খাঁ বাড়ির মুরব্বীরা নজরুলকে নার্গিসের বর হিসেবে তেমন পছন্দ করতেনা । বাঁধন হারা নজরুলকে তারা ছিন্নমূল বাউডুলে হিসেবেই দেখেছিলেন। কিন্তু গ্রাজুয়েট আলী আকবর খানের চাপে তারা প্রতিবাদ করতেন না। এক পর্যায়ে আলী আকবর খানের কাছে খোদ নজরুল বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করলেন, যার জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন। ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ আষাঢ় বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। 

এরপর শুরু হয় স্বপ্ন ভঙ্গের খেলা। আলী আকবর খান তার গ্রাম্য ভগিনীকে বিখ্যাত কবি নজরুলের জন্য গড়তে নেমে পড়লেন। অশিক্ষিত নার্গিসকে খুব কম সময়ে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব ছিল না কিন্তু তিনি শরৎচন্দ্র ও অন্যান্য সাহিত্যিকের উপন্যাসের নারী চরিত্র গুলো থেকে নার্গিসকে জ্ঞান দিতে থাকলেন। নজরুলের এইসব ভনিতা একেবারেই পছন্দ ছিল না, তিনি আলী আকবর খানকে তা জানালেও তিনি নজরুলকে পাত্তা দেন না। সেই সাথে খুব দ্রুত বিয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন, নিমন্ত্রন পত্রও অতিথিদের মাঝে বিলিয়ে ফেলেন। এসব ব্যাপার নজরুলকে পীড়া দেয়, আস্তে আস্তে তার মোহ ভাঙতে থাকে। 


এর ফাঁকে আলী আকবর খান আরো একটি কাজ করে যাচ্ছিলেন যা সবারই অগোচরে ছিল। তিনি নজরুলের জন্য কলকাতা থেকে আসা বন্ধুদের সব চিঠিই সরিয়ে ফেলতেন, সেই সাথে নজরুলের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে পাঠানো চিঠিও পোস্ট না করে নিজের কাছে রেখে দিতেন। তিনি ভালই জানতেন, নজরুলের বন্ধুরা কেউই কুমিল্লার আলী আকবর খানকে পছন্দ করেননা। সেই সাথে সন্দেহের চোখে দেখেন। এদিকে নজরুল বিয়েতে তার পক্ষের অতিথি হিসেবে বিরাজা সুন্দরী দেবী ও তার পরিবারকে মনোনিত করেন। বিয়ের আগের দিন সবাই দৌলতপুরে এসে উপস্থিত হন। কলকাতায় নজরুলের বন্ধুদের এমন সময় দাওয়াত দেওয়া হয় যেন কেউ আসতে না পারে। কবির অন্যতম ঘনিষ্ট বন্ধু কমরেড মোজাফফর আহমেদ নিমন্ত্রন পত্র পান বিয়ের পরে। 


এরপর এল সেই বহু প্রতিক্ষিত ৩ আষাঢ়। যতদূর জানা যায় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় এবং আকদ্ও সম্পন্ন হয়। কিন্তু কাবিনের শর্ত উল্লেখ করবার সময়ই ঝামেলা বাঁধে। আলী আকবর খান শর্ত জুড়ে দিতে চান, নজরুলকে ঘর জামাই থাকতে হবে। বাঁধন হারা নজরুল এই শর্ত প্রত্যাক্ষান করেন। আকদ্ হয়ে যাবার পর আনুষ্ঠানিক অন্যান্য কাজে যখন সবাই ব্যস্ত তখন নজরুল অন্তর্দ্বন্দে বিক্ষুব্ধ। তিনি ছুটে যান বিরজা সুন্দরী দেবীর কাছে। তাকে বলেন, “মা, আমি এখনই চলে যাচ্ছি”। বিরজা সুন্দরী দেবী বুজতে পারেন এই অবস্থায় নজরুলকে ফিরানো সম্ভব না। তিনি তার ছেলে বীরেন্দ্রকুমারকে নজরুলের সাথে দিয়ে দেন। সেই রাতে দৌলত পুর থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত কর্দমাক্ত (আষাঢ় মাস) রাস্তা পায়ে হেটে নজরুল ও বীরেন্দ্রকুমার কুমিল্লা পৌছেন। পরিশ্রমে ও মানসিক চাপে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। নজরুলের জীবনে নার্গিস পর্ব সেখানেই শেষ। 

১৯২১ সালের জুলাই মাসে নজরুল আলী আকবর খানকে চিঠিতে লেখেন, 

‘বাবা শশুর, 

আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মত ব্যবহার করে এসে যা কিছু কসুর করেছে, তা ক্ষমা করো সকলে, অবশ্য যদি আমার ক্ষমা চাওয়ার অধিকার থাকে। এইটুকু মনে রাখবেন, আম্র অন্তর-দেবতা নেহায়েৎ অসহ্য না হয়ে পড়লে আমি কখনো কাউকে ব্যাথা দিই না। যদিও ঘা খেয়ে খেয়ে আমার হৃদয়টাতে “ঘাটা বুজে’ গেছে, তবুও সেটার অন্তরতম প্রদেশটা এখনো শিরীষ ফুলের পরাগের মতই কোমল আছে। সেখানে খোঁচা লাগলে আর আমি থাকতে পারিনে। তা-ছাড়া আমিও আপনাদের পাঁচজনের মতই মানুষ, আমার গন্ডারের চামড়া নয়; কেবল সহ্য গুনটা একটু বেশি। আমার মান-অপমান সম্বন্ধে কান্ডজ্ঞান ছিল না বা ‘কেয়ার’ করিনি বলে আমি কখনো এত বড় অপমান সহ্য করিনি যাতে আম্র ‘ম্যানলিনেসে’ বা পৌরুষে গিয়ে বাজে- যাতে আমায় কেউ কাপুরুষ, হীন ভাবতে পারে। আমি সাধ করে পথের ভিখারী সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্র আত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি। আপন জনের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এই হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙ্গে দিয়েছে বাবা! আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। দোয়া করবেন আমার এ ভুল যেন দ’দিনেই ভেঙে যায়- এ অভিমান যেন চোখের জলে ভেসেযায়! 

বাকী উৎসবের জন্য যত শীগগীর পারি বন্দোবস্ত করবো। বাড়ির সকলকে দস্তুরমত সালাম দোয়া জানাবে। অন্যান্য যাদের কথা রাখতে পারি নি তাদের ক্ষমা করতে বলবেন। তাকেও ক্ষমা করতে বলবেন, যদি এই ক্ষমা চাওয়া ধৃষ্টতা না হয়। 

আরজ-ইতি 

চিরসত্য স্নেহ-সিক্ত 

নূরু। 


১৯২১ এর সেপ্টেম্বর মাসে আলী আকবর খান কুমিল্লা হতে আবার কলকাতা পৌছে নজরুলের সাথে দেখা করেন। নজরুলকে তিনি টাকার লোভ দেখান, এতে নজরুল আরো রেগে যান। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর নজরুলের সাথে নার্গিসের আর কোন যোগাযোগও হয় নি। ১৯৩৭ সালে নজরুলকে নার্গিস একটা চিঠি লেখেন। চিঠি প্রাপ্তির সময় সেখানে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। নজরুল তাকেই চিঠি পড়তে বলেন। চিঠি পড়া শেষে শৈলজানন্দ নজরুলকে উত্তর লিখতে বলেন। 

১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নজরুল নার্গিসকে আর একটি চিঠি লেখেন। এর প্রায় বছর খানেক আগেই শিয়ালদহতে নার্গিস ও নজরুলের উপস্থিতিতে উভয়ের আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। 


বিচ্ছেদের সাত-আট মাসের মাথায় আলী আকবর খানে বই ব্যবসার ম্যানেজার আজিজুল হাকিমের সাথে নার্গিসের বিয়ে হয়। আজিজুল হাকিমও বাংলা সাহিত্যে কবি হিসেবে সমাদৃত। এক সময় তিনিই নার্গিসের কাছ থেকে পাওয়া সেই ১৯২১ সালে আলী আকবর খানের সরিয়ে ফেলা নজরুলের বন্ধুদের ও বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠি গুলো প্রকাশ করেন। আলী আকবর খানের মূল চরিত্র জনসম্মুক্ষে প্রকাশিত হয়। 

(তথ্য সূত্র: নজরুলের জীবনে নারী ও প্রেম; ড. আবুল আজাদ) নারী ও প্রেম; ড. আবুল আজাদ)

published by :-Md.Al-Amin

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.